চতুর্গুণ ভারী হইয়া উঠিল এবং পায়ের জুতা হাতে করিয়া সিক্ত বস্ত্রে ক্লান্ত দেহে যখন সেবাশ্রমের উদ্দেশে যাত্রা করা গেল, তখন সন্ধ্যা হয়-হয়; এবং ওয়াকিবহাল এক ব্যক্তিকে আশ্রমের সন্ধান জিজ্ঞাসা করায় সে নিঃসংশয়ে জানাইয়া দিল যে, সে একটা জঙ্গলের মধ্যে ব্যাপার, তথায় যাইবার কোন নির্দিষ্ট রাস্তা নাই এবং দূরত্বও যেমন করিয়া হউক ক্রোশ-দুয়ের কম নয়। মন্টু কাঁদ-কাঁদ হইয়া উঠিল এবং আমার বাহন ভোলা প্রায় হাল ছাড়িয়া দিল। কিন্তু উপায় কি? জলের মধ্যে এই পথের ধারেও ত দাঁড়াইয়া থাকা যায় না; কোথাও ত যাওয়া চাই, অতএব চলিতেই হইল। বৃষ্টি থামার নাম নাই, প্রভূত রজ ছিট্কাইয়া মাথায় উঠিয়াছে, শ্রীকণ্ঠকে পদতল ক্ষত-বিক্ষত, রাত্রি সমাগতপ্রায়, এমনি অবস্থায় দেখা গেল, শ্রীমান সুরেশচন্দ্র একটা চালার আবরণ ভেদ করিয়া বাহির হইতেছে। সে একদিন আগে আসিয়াছে, সে সব জানে, তাহার এইপ্রকার আকস্মিক অভ্যাগমে আমাদের মধ্যে যেন একটা আনন্দ-কলরব উঠিয়া গেল। অপরাহ্ণ-শেষের স্বল্পালোকে দূর হইতে তাহার চেহারা ভাল দেখা যায় নাই, কিন্তু কাছে আসিলে দেখা গেল, মুখ তাহার ভোলার চেয়ে, এমন কি, মন্টুর চেয়েও অধিকতর মলিন। সুরেশ ছেলেটির বয়স কম, কিন্তু এই অল্পবয়সেই সে জ্ঞান লাভ করিয়াছে যে, সংসার দুঃখময়, এখানে প্রফুল্ল হইয়া উঠিবার অধিক অবকাশ নাই। সে গম্ভীর ও সংক্ষেপে সংবাদ দিল যে, বৃন্দাবন কলেরায় প্রায় উজাড় হইয়াছে এবং যে দু-চারজন অবশিষ্ট আছে, তাহারা ডেঙ্গুতে শয্যাগত। কাল সে সেবাশ্রমেই ছিল, সেখানে বামুন নাই, চাকর পলাইয়াছে, ব্রহ্মচারীরা সব জ্বরে মর-মর। গোটা-সাতেক কুকুর আছে, একটার ল্যাজে ঘা, একটা মস্ত রামছাগল আছে তার নাম রামভকত, সে রাজ্যসুদ্ধ লোককে গুঁতাইয়া বেড়ায়। সেবাশ্রমের স্বামীজী বেদানন্দ শুধু ভাল আছেন, আজ তিনি রাঁধিয়াছেন এবং সুরেশ নিজে বাসন মাজিয়াছে। গরম চায়ের আশা ত সুদূরপরাহত, রাত্রে দুটা ভাত পাওয়াই শক্ত। পাশে চাহিয়া দেখিলাম, ভোলা ঊর্ধ্বমুখে বোধ করি তাহার দেশের জগবন্ধু স্মরণ করিতেছে এবং শ্রীমান মন্টুর চোখ দিয়া জল পড়িতেছে। ক্ষণকাল স্তব্ধভাবে থাকিয়া আমরা আবার গন্তব্যস্থানের অভিমুখেই প্রস্থান করিলাম, কিন্তু সমস্ত পথটায় কাহারও মুখে আর কথা রহিল না।
যথাকালে সেবাশ্রমে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। অধ্যক্ষ স্বামীজী বেদানন্দ আমাদের সানন্দে ও সমাদরে গ্রহণ করিলেন। গরম চা পাইতে কিছুমাত্র বিলম্ব হইল না। কারণ, চাকর না থাকিলেও একজন নূতন দাসী আসিয়াছে। বামুন ঠাকুর কি-একটা অছিলায় দিন-দুই পলাতক ছিল, সেও ভাগ্যক্রমে আজ বিকালে আসিয়া হাজির হইয়াছে। সাতটা কুকুরের কথা ঠিক। একটার ল্যাজেও ঘা আছে বটে।