মাস-খানেক হইল শিবদাস সাংঘাতিক পীড়ায় শয্যাগত হইয়াছেন, তাঁহার জীবনের আশা নাই। ভীম, নিজের কাজকর্ম ফেলিয়া দিবারাত্রি পিতার সেবায় নিযুক্ত রহিয়াছে, শুধু সকালবেলায় ঘণ্টা-খানেকের জন্য নিজের বাসায় ফিরিয়া আসিয়া এ দিকের বন্দোবস্ত ঠিকঠাক করিয়া যাইতেছে। জনশ্রুতি উঠিল, শিবদাস ভীমের অসাক্ষাতে এক উইল করিয়াছেন, তাহাতে জ্যেষ্ঠপুত্র ভীমের অংশে শূন্য পড়িয়াছে। এই দুঃসংবাদ বিনোদিনী লোকের মুখে শনিতে পাইয়া আজ সকালে স্বামীকে জানাইয়া দিল, এবং তাহারাই উত্তরে অন্তর্যামী ভীমচন্দ্র হাত চাপড়াইয়া আস্ফালন করিয়া কহিল, এমন একটা কাজ তাহার অসাক্ষাতে ঘটিলেও, সে তাহার বিমাতার মুখের দিকে চাহিবামাত্রই বিদিত হইত, কোনমতেই তাহার অগোচর থাকিত না।
ভীম দ্রুতপদে এ বাটীতে আসিয়া এঘর-ওঘর করিয়া সোজা রান্নাঘরে আসিয়া দাঁড়াইল। তাহার বিমাতা সুখদা তখন মৃতকল্প স্বামীর জন্য পথ্য প্রস্তুত করিতেছিলেন, ভীম ডাকিয়া বলিল, 'মা শোন।' সুখদা শ্রান্ত ক্লান্ত চোখ তুলিয়া চাহিলেন। ভীম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাহিয়া বলিল, 'বাবা উইল করেচেন নাকি?' সুখদা একটা সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া, চিঁচিঁ করিয়া কহিলেন, 'কি করে জানব বাবা, কি তিনি করেচেন? আমি ত দুঃখে কষ্টেই মারা যাচ্চি—আমার যা হচ্চে তা ভগবানই জানেন।' ভীম একটুখানি নরম হইয়া বলিল, 'শুনলুম তোমার মতলবেই উইল হয়েচে, আর তাতে আমার নামগন্ধও নেই।' সুখদা চোখে আঁচল দিয়া অশ্রুবিকৃত কণ্ঠে বলিলেন, 'লোকে ত বলবেই। আমি তোমার সৎমা বৈ ত নই—বেশ ত, বাবা, তিনি এখনও বেঁচে আছেন, তাঁকেই জিজ্ঞেসা কর না কেন?
ভীমের বুকের ভিতর হইতে সমস্ত গ্লানি ধুইয়া মুছিয়া গেল। বিমাতার কান্না ও কণ্ঠস্বরে আর তাহার লেশমাত্র সন্দেহ রহিল না যে, এ-সব মিথ্যা রটনা। সে তৎক্ষণাৎ অনুতপ্ত হইয়া বলিয়া উঠিল, 'আমি বিশ্বাস করিনি, মা, আমি বিশ্বাস করিনি। আমি কোন কথা কাউকে জিজ্ঞেস কত্তে চাইনে—এ সমস্ত মিথ্যে।' বলিয়া সে বাহিরে চালিয়া গেল। পিতার ঘরে গিয়া আজ মরণাপন্ন পিতৃমুখের দিকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও মমতার সহিত চাহিয়া রহিল, তাঁহার নাড়ী দেখিয়া, পায়ে হাত বুলাইয়া দিল, একটু গরম দুধ পান করাইয়া দিল। এখন, সব কাজেই তাহার বুক ফুলিয়া ফুলিয়া উঠিতে লাগিল। বছর-তিনেক পূর্বে যেদিন পিতার স্পষ্ট কথায় সে স্ত্রীকে লইয়া গৃহত্যাগ করিয়া আলাদা বাসা করিয়াছিল, সেদিন পিতার উপর তাহার অত্যন্ত অভিমান হইয়াছিল। সেই অভিমানের জন্য এখন সে মনে মনে ক্ষমা ভিক্ষা করিল এবং মুখ ফিরাইয়া চোখের জল মুছিল। কিন্তু, এখানেও সে বেশিক্ষণ বসিয়া থাকিতে পারিল না। স্ত্রীকে এই সুসংবাদটা না দেওয়া পর্যন্ত সে ত কিছুতেই সুস্থির হইতে পারে না। ঘরের বাহিরে আসিয়া চটি-জুতা পায়ে দিয়া ভীম চটপট শব্দে বাসার দিকে রওনা হইয়া পড়িল। বিনোদিনী তখন রাঁধিতেছিল, ভীম কবাটের সুমুখে দাঁড়াইয়া উচ্চকণ্ঠে বলিল—'ওগো, শুনচ?'