এই ওয়েবসাইটটি সবচেয়ে ভালো ভাবে দেখতে হলে Mozilla Firefox, Microsoft Edge অথবা Apple Safari browser ব্যবহার করুন।

গল্প  :  অনুরাধা         
পরিচ্ছেদ: / 7
পৃষ্ঠা: / 25
পিতার মৃত্যুতে পুত্র গগন পাইল এক জরাজীর্ণ ডিক্রি-করা পৈতৃক বাস্তুভিটা, আকণ্ঠ ঋণ-ভারগ্রস্ত গ্রাম্য-সম্পত্তি, গোটাকয়েক গরু-ছাগল-কুকুর-বিড়াল এবং ঘাড়ে পড়িল পিতার দ্বিতীয় পক্ষের অনূঢ়া কন্যা অনুরাধা।

এইবার পাত্র জুটিল গ্রামেরই এক ভদ্রব্যক্তি। গোটা পাঁচ-ছয় ছেলেমেয়ে ও নাতিপুতি রাখিয়া বছর-দুই হইল তাহার স্ত্রী মরিয়াছে, সে বিবাহ করিতে চায়।

অনুরাধা বলিল, দাদা, কপালে রাজপুত্র ত জুটল না, তুমি এইখানেই আমার বিয়ে দাও। লোকটার টাকাকড়ি আছে, তবু দুটো খেতে-পরতে পাব।

গগন আশ্চর্য হইয়া কহিল, সে কি কথা! ত্রিলোচন গাঙ্গুলির পয়সা আছে মানি, কিন্তু ওর ঠাকুরদাদা কুল ভেঙ্গে সতীপুরের চক্রবর্তীদের ঘরে বিয়ে করেছিল জানিস? ওদের আছে কি?

বোন বলিল, আর কিছু না থাক টাকা আছে। কুল নিয়ে উপোস করার চেয়ে দু-মুঠো ভাত-ডাল পাওয়া ভালো দাদা।

গগন মাথা নাড়িয়া বলিল, সে হয় না,—হবার নয়।

কেন নয় বল ত? বাবা ও-সব মানতেন, কিন্তু তোমার ত কোন বালাই নেই।

এখানে বলা আবশ্যক পিতার গোঁড়ামি পুত্রের ছিল না। মদ্য-মাংস ও আরও একটা আনুষঙ্গিক ব্যাপারে সে সম্পূর্ণ মোহমুক্ত পুরুষ। পত্নী-বিয়োগের পরে ভিন্নপল্লীর কে একটি নীচজাতীয়া স্ত্রীলোক আজও তাহার অভাব মোচন করিতেছে এ কথা সকলেই জানে।

গগন ইঙ্গিতটা বুঝিল, গর্জিয়া বলিল, আমার বাজে গোঁড়ামি নেই, কিন্তু কন্যাগত কুলের শাস্ত্রাচার কি তোর জন্যে জলাঞ্জলি দিয়ে চোদ্দপুরুষ নরকে ডোবাব? কৃষ্ণের সন্তান, স্বভাব-কুলীন আমরা—যা যা, এমন নোংরা কথা আর কখনো মুখে আনিস নে। এই বলিয়া সে রাগ-করিয়া চলিয়া গেল, ত্রিলোচন গাঙ্গুলির প্রস্তাবটা এইখানেই চাপা পড়িল।

গগন হরিহর ঘোষালকে ধরিয়া পড়িল—কুলীন ব্রাক্ষ্মণকে ঋণমুক্ত করিতে হইবে। কলিকাতায় কাঠের ব্যবসায়ে হরিহর লক্ষপতি ধনী। একদিন তাঁহার মাতুলালয় ছিল এই গ্রামে, বাল্যে বাবুদের বহু সুদিন তিনি চোখে দেখিয়াছেন, বহু কাজেকর্মে পেট ভরিয়া লুচিমণ্ডা আহার করিয়া গিয়াছেন, টাকাটা তাঁহার পক্ষে বেশি নয়, তিনি সম্মত হইলেন। চাটুয্যেদের সমস্ত ঋণ পরিশোধ করিয়া হরিহর গণেশপুর ক্রয় করিলেন, কুণ্ডুদের ডিক্রির টাকা দিয়া ভদ্রাসন ফিরাইয়া লইলেন, কেবল মৌখিক শর্ত এই রহিল যে, বাহিরের গোটা দুই-তিন ঘর কাছারির জন্য ছাড়িয়া দিয়া গগন অন্দরের দিকটায় যেমন বাস করিতেছে তেমনিই করিবে।

তালুক খরিদ হইল, কিন্তু প্রজারা মানিতে চাহিল না। সম্পত্তি ক্ষুদ্র, আদায় সামান্য, সুতরাং বড় রকমের কোন ব্যবস্থা করা চলে না; কিন্তু, অল্পের মধ্যেই কি কৌশল যে গগন খেলিতে লাগিল, হরিহরের পক্ষের কোন কর্মচারী গিয়াই গণেশপুরে টিকিতে পারিল না। অবশেষে গগনের নিজেরই প্রস্তাবে সে নিজেই নিযুক্ত হইল কর্মচারী; অর্থাৎ ভূতপূর্ব ভূস্বামী সাজিলেন বর্তমান জমিদারদের গোমস্তা। মহাল শাসনে আসিল, হরিহর হাঁফ ফেলিয়া বাঁচিলেন, কিন্তু আদায়ের দিক দিয়া রহিল যথাপূর্বস্তথা পরঃ।