এই ওয়েবসাইটটি সবচেয়ে ভালো ভাবে দেখতে হলে Mozilla Firefox, Microsoft Edge অথবা Apple Safari browser ব্যবহার করুন।

উপন্যাস  :  গৃহদাহ         
পরিচ্ছেদ: / 44
পৃষ্ঠা: / 212
সুরেশ কহিল, তার মানে—এমন কদর্য বাড়ি যে শহরের মধ্যে থাকতে পারে, এমন ভয়ানক বিশ্রী খাওয়াও যে কোন মানুষ মুখে দিতে পারে, চোখে না দেখলে আমি কোনমতে বিশ্বাস করতে পারতুম না। তা যাই হোক, এ জায়গার তুমি সন্ধান পেলেই বা কিরূপে, আর তোমার সাবেক বাসা—তা সে যত মন্দই হোক, এর সঙ্গে তুলনাই হয় না—তাই বা পরিত্যাগ করলে কেন?

বন্ধু-স্নেহ বন্ধুর বুকে আঘাত করিল। মহিম আর তাহার নির্বিকার গাম্ভীর্য বজায় রাখিতে পারিল না, আর্দ্রস্বরে কহিল, সুরেশ, তুমি আমার গ্রামের বাড়ি দেখনি; তা হলে বুঝতে, এ বাসায় আমার কিছুমাত্র ক্লেশ হতে পারে না। আর খাওয়া—আরও পাঁচজন ভদ্রসন্তান যা স্বচ্ছন্দে খেতে পারে, আমি পারব না কেন?

সুরেশ উত্তেজিত হইয়া বলিল, এ কেনর কথা নয়। ভালমন্দ জিনিস সংসারে অবশ্যই আছে। ভাল ভালই লাগে, মন্দ যে মন্দ লাগে, তাতে আর সংশয় নেই। আমি শুধু জানতে চাই, তোমার এত দুঃখ করবার প্রয়োজন কি হয়েছে?

মহিম চুপ করিয়া মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিল—কথা কহিল না।

সুরেশ কহিল, তোমার প্রয়োজন তোমার থাক, আমি জানতে চাই না। কিন্তু আমার প্রয়োজন তোমাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া। আমি গাড়ি ডেকে তোমার জিনিসপত্র এখনই আমাদের বাড়ি নিয়ে যাব। এখানে তোমাকে ফেলে রেখে যদি যাই, চোখে আমার ঘুম আসবে না, মুখে অন্ন রুচবে না। তোমাদের বাসার চাকরকে ডাক, একটা গাড়ি নিয়ে আসুক। এই বলিয়া সুরেশ মহিমকে টানিয়া তুলিয়া স্বহস্তে তাহার বিছানা গুটাইতে প্রবৃত্ত হইল।

মহিম বাধা দিয়া টানা-হেঁচড়া বাধাইয়া দিল না। কিন্তু শান্ত গম্ভীরস্বরে বলিল, পাগলামি করো না সুরেশ।

সুরেশ চোখ তুলিয়া কহিল, পাগলামি কিসের? তুমি যাবে না?

না।

কেন যাবে না? আমি কি তোমার কেউ নই? আমার বাড়ি যাওয়ায় কি তোমার অপমান হবে?

না।

তবে?

মহিম কহিল, সুরেশ, তুমি আমার বন্ধু। এমন বন্ধু আমার আর নেই; সংসারে এমন আর কয়জনের আছে, তাও জানি না। এতকাল পরে এ বস্তু আমি একটুখানি দেহের আরামের জন্য খুইয়ে বসব, আমাকে কি তুমি এত বড়ই নির্বোধ পেয়েছ!

সুরেশ কহিল, বন্ধুত্ব জিনিসটি তোমার ত একার নয় মহিম। আমারও ত তাতে একটা ভাগ আছে। খোয়া যদি যায়, সে ক্ষতি যে কত বড়, সে বোঝবার সাধ্য আমার নেই—আমি কি এতই বোকা? আর এত সতর্ক-সাবধান, এত হিসাবপত্র করে না চললেই এ বন্ধুত্ব যদি নষ্ট হয়ে যায় ত যাক না মহিম! এমনই কি তার মূল্য যে, সেজন্য শরীরের আরামটাকে উপেক্ষা করতে হবে?

মহিম হাসিয়া বলিল, না, এবার হেরেছি। কিন্তু একটা কথা তোমাকে নিশ্চয় জানাচ্ছি সুরেশ। তুমি মনে করেছ— শখ করে দুঃখ সইতে আমি এখানে এসেছি, তা সত্য নয়।

সুরেশ কহিল, বেশ ত, সত্য নাই হল। আমি কারণ জানতেও চাই না—কিন্তু যদি টাকা বাঁচানই তোমার উদ্দেশ্য হয়, আমাদের বাড়িতে এসে থাক না, তাতে ত তোমার উদ্দেশ্য মাটি হয়ে যাবে না।

মহিম ঘাড় নাড়িয়া সংক্ষেপে কহিল, এখন থাক সুরেশ। কষ্ট যদি সত্যই হয়, তোমাকে জানাব।

সুরেশ জানিত, মহিমকে তাহার সঙ্কল্প হইতে টলান অসাধ্য। সে আর জিদ না করিয়া একরকম রাগ করিয়াই চলিয়া গেল। কিন্তু বন্ধুর এই থাকা এবং খাওয়ার ব্যবস্থাটা চোখে দেখিয়া তাহার মনের মধ্যে সূচ বিঁধিতে লাগিল।

সুরেশ ধনীর সন্তান, এবং মহিমকে সে অকপটে ভালবাসিত। তাহার অন্তরের আকাঙ্ক্ষা, কোনমতে সে বন্ধুর একটা কাজে লাগে। কিন্তু মহিমকে সে কোনদিন সাহায্য লইতেই স্বীকার করাইতে পারে নাই—আজিও পারিল না।