আদেশ শুনিয়া বিভূতির মাথার মধ্য দিয়া বিদ্যুৎ বহিয়া গেল। তাহার শ্বশুর-শাশুড়ীর মুখ, শালী-শালাদের মুখ, চাকরির মুখ, স্ত্রীর মুখ, সমস্ত একই সঙ্গে মনে পড়িয়া মুখখানা ভয়ে ভাবনায় বিবর্ণ হইয়া উঠিল, সে জড়িত-কণ্ঠে কহিতে চাহিল,—কিন্তু দাদা, দোষের বিচার না করেই—
শিবরতন শান্তস্বরে কহিলেন, মা অত্যন্ত অপমানিত বোধ করেছেন, এ তোমরাও দেখলে। তাঁর কি দোষ, কতখানি দোষ, এ বিচারের ভার আমার ওপর নেই। যাঁদের বিচার করতে পারি তাঁদের প্রতি আমার এই আদেশ রইল। এখন কি করবে সে তুমি জানো।
বিভূতি কহিল, আপনার হুকুম চিরদিন মাথায় বয়ে এসেছি দাদা, কোনদিন কোন স্বাধীনতা পাইনি। আজও তাই হবে, কিন্তু—
এই কিন্তুটা সেও শেষ করিতে পারিল না, শিবরতনও নীরবে অধোমুখে বসিয়া রহিলেন।
বিভূতি ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া বোধ করি বা দাদার কাছে কিছু প্রত্যাশা করিল। কিন্তু কিছুই না পাইয়া সে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, দাদা, আমি চললুম—এই বলিয়া সে ধীরে ধীরে
অন্তঃপুরের অভিমুখে প্রস্থান করিল।
শিবরতন কোন কথা কহিলেন না, তেমনি অধোমুখে স্থির হইয়া বসিয়া রহিলেন। পূজার বাড়ি, আজও আত্মীয়, অনাত্মীয়, কুটুম্ব, প্রতিবেশী ছেলেমেয়ে চাকর-দাসীতে পরিপূর্ণ। এই-সকলের মাঝখানে যে ন-বউমা তাঁহার প্রাণাধিক স্নেহের পাত্রী, তাঁহারই এতবড় অপমান, এতবড় শাস্তি যে কি করিয়া অনুষ্ঠিত হইবে, তাহা তিনি নিজেও ভাবিয়া পাইলেন না। তাঁহার নতনেত্র হইতে বড় বড় তপ্ত অশ্রুর ফোঁটা টপটপ করিয়া মেঝের উপর ঝরিয়া পড়িতে লাগিল,—কিন্তু 'বিভূতি' বলিয়া একবার ফিরিয়া ডাকিতে পারিলেন না। কেবল মনে মনে প্রাণপণ বলে বলিতে লাগিলেন—কিন্তু, কিন্তু মা যে! মা যে! তাঁর যে অপমান হয়েছে!