এই ওয়েবসাইটটি সবচেয়ে ভালো ভাবে দেখতে হলে Mozilla Firefox, Microsoft Edge অথবা Apple Safari browser ব্যবহার করুন।

অজ্ঞাত রচনা  :  ৫৭তম জন্মদিনে প্রতিভাষণ         
পরিচ্ছেদ: / 1
পৃষ্ঠা: / 3
এমনি দিনে একজন মনীষীকে সকৃতজ্ঞ-চিত্তে স্মরণ করি; তিনি স্বর্গীয় পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন আমাদের ছেলেবেলায় ইস্কুলের শিক্ষক। হঠাৎ দেখা হয়ে গেল এই নগরেরই এক পথের ধারে। ডেকে বললেন, শরৎ, তোমার লেখা আমি পড়িনি, কিন্তু লোকে বলে সেগুলো ভালই হচ্ছে। একদিন তোমাদের আমি পড়িয়েচি। আমার আদেশ রইল—যা সত্যই জানো না, তা কখনো লিখো না। যাকে উপলব্ধি করোনি, সত্যানুভূতিতে যাকে আপন করে পাওনি, তাকে ঘটা করে ভাষার আড়ম্বরে ঢেকে পাঠক ঠকিয়ে বড় হতে চেয়ো না। কেন না এ ফাঁকি কেউ-না-কেউ একদিন ধরবেই, তখন লজ্জার অবধি থাকবে না। আপন সীমানা লঙ্ঘন করাই আপন মর্যাদা লঙ্ঘন করা। এ ভুল যে করে না, তার আর যে দুর্গতিই হোক, তাকে লাঞ্ছনা ভোগ করতে হয় না। অর্থাৎ, বোধ হয় তিনি এ কথাই বলতে চেয়েছিলেন যে, পেটের দায়ে যদি-বা কখনও ধার করো, ধার করে কখনও বাবুয়ানি করো না।

সেদিন তাঁকে জানিয়েছিলাম, তাই হবে।

আমার সাহিত্য-সাধনা তাই চিরদিন স্বল্পপরিধিবিশিষ্ট। হয়ত, এ আমার ত্রুটি, হয়ত এ-ই আমার সম্পদ, আপনাদের স্নেহ ও প্রীতি পাবার সত্য অধিকার। হয়ত আপনাদের মনের কোণে এই কথাটা আছে—এর শক্তি কম, তা হোক, কিন্তু এ কখনও অনেক জানার ভান করে আমাদের অকারণ প্রতারণা করেনি।

এমনি একটা জন্মদিন উপলক্ষে বলেছিলাম চিরজীবী হবার আশা করিনে, কারণ সংসারে অনেক-কিছুর মতো মানব-মনেরও পরিবর্তন আছে; সুতরাং, আজ যা বড়, আর একদিন তা-ই যদি তুচ্ছ হয়ে যায় তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। সেদিন আমার সাহিত্যসাধনার বৃহত্তর অংশও যদি অনাগতর অবহেলায় ডুবে যায়, আমি ক্ষোভ করব না। শুধু মনে এই আশা রেখে যাবো, অনেক-কিছু বাদ দিয়েও যদি সত্য কোথাও থাকে সেটুকু আমার থাকবে। সে আমার ক্ষয় পাবে না। ধনীর অজস্র ঐশ্বর্য নাই-বা হলো, বাগ্‌দেবীর অর্ঘ্যসম্ভারে ঐ স্বল্প সঞ্চয়টুকু রেখে যাবার জন্যই আমার আজীবন সাধনা। দিনের শেষে এই আনন্দ মনে নিয়ে খুশী হয়ে বিদায় নেবো, ভেবে যাবো আমি ধন্য, জীবন আমার বৃথায় যায়নি।

উপসংহারে একটা প্রচলিত রীতি হচ্ছে, শুভানুধ্যায়ী প্রীতিভাজন বন্ধুজনের কাছে কৃতজ্ঞতা জানানো। কিন্তু এ প্রকাশ করার ভাষা খুঁজে পেলাম না। তাই শুধু জানাই আপনাদের কাছে সত্যই বড় কৃতজ্ঞ।